ক্রেডিট কার্ডের ওয়ালেট লোডিং ফি কী ও কেন? | What is Wallet Loading Fee on Credit Card?

ক্রেডিট কার্ডের ওয়ালেট লোডিং ফি কী ও কেন? | What is Wallet Loading Fee on Credit Card?


আজকের দ্রুতগতির ডিজিটাল অর্থনীতিতে মোবাইল ওয়ালেট হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে বিকাশ ও নগদ, রকেট, উপায়, ট্যাপ ইত্যাদি মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসগুলো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের কাছে এসব ওয়ালেটে টাকা লোড করা যতটা সহজ মনে হয়, এর পেছনে লুকিয়ে থাকে একটি অতিরিক্ত খরচ ওয়ালেট লোডিং ফি। চলুন দেখি এর পেছনে আসল যুক্তি কী এবং এর সঙ্গে জড়িত নৈতিক প্রশ্নগুলো কীভাবে দেখা যায়।

ওয়ালেট লোডিং ফি’র পেছনের যুক্তিগুলো

ক্রেডিট কার্ড = ধার করা অর্থ

ক্রেডিট কার্ড দিয়ে যখন আপনি মোবাইল ওয়ালেটে টাকা লোড করেন, তখন আপনি মূলত একটি অগ্রিম ঋণ নিচ্ছেন। যেহেতু এটি সরাসরি কোনো পণ্য বা সেবার ক্রয় নয়, তাই এটি অনেকটা স্বল্পমেয়াদি লোন হিসেবেই বিবেচিত হয়। তবে এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ব্যাংকের দিক থেকে। 

ওয়ালেট লোডিং ফি ক্যাশ অ্যাডভান্স হিসেবে গণ্য

বেশিরভাগ ব্যাংক ওয়ালেট লোডিং লেনদেনের জন্য ওয়ালেট লোডিং ফি চার্জ করে। ব্যাংক এই লেনদেন গুলোকে ক্যাশ অ্যাডভান্স হিসেবে নিয়ে এই চার্জ আদায় করে। ওয়ালেট লোডিং ফি কর্তন নিয়ে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন এই চার্জ আরোপ করে তার কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ আমি উল্লেখ করছি:

আর্থিক ফাঁক বন্ধ করা

অনেক সময় ব্যবহারকারীরা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ওয়ালেটে টাকা এমএফএস/ডিজিটাল ওয়ালেটে অ্যাড মানি করে পরে তা ক্যাশ আকারে তুলে নেন, যা ব্যাংকের দৃষ্টিতে ক্যাশ উইথড্রাল সিস্টেমকে বাইপাস করার একটি উপায়। এজন্য ব্যাংকগুলো এতে চার্জ বসায়।

প্রসেসিং খরচ রিকভার করা

প্রত্যেকটি লেনদেন পেমেন্ট গেটওয়ে, ফ্রড ডিটেকশন সিস্টেম ও অন্যান্য প্রসেসিং সংক্রান্ত খরচ থাকে। এই ফি এসব ব্যাকএন্ড খরচ কাভার করতে সাহায্য করে।

ওয়ালেট লোডিং ফি ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে বিশ্লেষণ

ওয়ালেট লোডিং ফি আদায়ের ফলে নৈতিক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়গুলো ধাপে ধাপে আলোচনা করা হলো: 

লেনদেন নীতিতে অসঙ্গতি

সাধারণভাবে কোন মার্চেন্ট আউটলেট/অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা হলে তার জন্য কোন চার্জ করা হয় না।অথচ নিজের ওয়ালেটে টাকা লোড করলে ফি কাটা হয়। এই অসঙ্গতি অনেকের কাছে অনৈতিক মনে হতে পারে।

ব্যবহারকারীর স্বাধীনতায় অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ধার নেওয়ার পর সেই অর্থ কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা নির্ধারণের অধিকার সম্পূর্ণভাবে তার নিজের। কিন্তু ওয়ালেট লোডে অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করা আসলে গ্রাহকের এই স্বাধীনতার ওপর অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ।

প্রথমত, গ্রাহক ওয়ালেট লোড করার সময় ব্যাংকের কোনো নগদ উত্তোলন চ্যানেলই ব্যবহার করেন না, যেমন এটিএম, কার্ড চেক, ব্রাঞ্চ কাউন্টার, ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপ। অর্থাৎ এটি ব্যাংকের দৃষ্টিতে সাধারণ ক্যাশ অ্যাডভান্স নয়। বরং গ্রাহক সম্পূর্ণ ডিজিটালভাবে কোনো তৃতীয় পক্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস গ্রহণ করছেন, এবং সেটি মূলত ই-কমার্স লেনদেনের মতোই কাজ করে।

দ্বিতীয়ত, গ্রাহক এই অর্থ বিনা খরচে নগদায়ন করতে পারেন না। মোবাইল ওয়ালেট থেকে টাকা তুলতে তাকে প্রায় ২% পর্যন্ত ক্যাশ-আউট চার্জ দিতে হয়। অর্থাৎ গ্রাহক একাধিক স্তরে খরচের সম্মুখীন হন, ব্যাংক থেকে ই-কমার্স ট্রানজেকশনের চার্জ এবং ওয়ালেট থেকে নগদ উত্তোলনের চার্জ, যা মিলিয়ে মোট খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।

তৃতীয়ত, ব্যাংক শুরুতে এই লেনদেনকে ‘পারচেজ ট্রানজেকশন’ হিসেবে দেখালেও পরবর্তীতে “ওয়ালেট লোডিং ফি” নামে অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করে। অথচ এই লেনদেনে ব্যাংক মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেট (MDR) ঠিকভাবেই পেয়ে থাকে। ফলে ব্যাংক দ্বৈত সুবিধা পেলেও গ্রাহক অযৌক্তিক খরচের বোঝা বহন করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সব মিলিয়ে, ওয়ালেট লোডে অতিরিক্ত চার্জ আরোপ শুধু গ্রাহকের ব্যবহারিক স্বাধীনতাকেই সীমিত করে না, বরং ডিজিটাল লেনদেনে আস্থা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করে।

পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব

অনেকেই ওয়ালেট লোড করার পরেই বুঝতে পারেন যে তাদের কার্ড থেকে অতিরিক্ত টাকা কাটা হয়েছে। এই ধরনের আগাম তথ্য না জানানো ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করতে পারে। তবে এই অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র নতুনদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। রেগুলার ব্যবহারকারীরা স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়ে অবগত।

একটি লেনদেনে দ্বিগুণ উপার্জন?

যখন কোনো ব্যাংক বা কার্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের থেকে ওয়ালেট লোডের জন্য ফি আদায় করে এবং একই সময়ে Merchant Discount Rate (MDR) এর মাধ্যমে সেই ওয়ালেট কোম্পানি থেকেও কমিশন পায়, তখন তা একটি নৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়।

কারণ এক্ষেত্রে একটিমাত্র লেনদেন থেকে দুই উৎসে উপার্জন করা হচ্ছে, একদিকে গ্রাহকের কাছ থেকে ফি, অন্যদিকে মার্চেন্টের কাছ থেকে কমিশন। যদিও এই দুটি চার্জ ভিন্ন ভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত, তবুও অনেকের কাছে এটি Double-Dipping বা ‘এক ইস্যুতে দুইবার লাভ’ মনে হতে পারে। আর এখানেই ট্রান্সপারেন্সি ও কাস্টমার ফ্রেন্ডলিনেস প্রশ্নের মুখে পড়ে।

MDR সম্পর্কিত বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন.....

সচেতন গ্রাহক হিসেবে ওয়ালেট লোডিং ফি তে দৃষ্টিভঙ্গি 

একজন সাধারণ গ্রাহক হিসেবে আমি যখন মোবাইল ওয়ালেটে ফান্ড অ্যাড করি, তখন সেটিকে অনেকেই শুধুই টাকা জমা দেওয়া হিসেবে দেখে থাকেন। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, এখানে আমি একটি নির্দিষ্ট ডিজিটাল সেবা গ্রহণ করছি, যেটি একপ্রকার ই-কমার্স লেনদেনের মধ্যে পড়ে। কেননা, আমি একটি নির্দিষ্ট গেটওয়ে ব্যবহার করে টাকা পাঠাচ্ছি, যা প্রযুক্তিনির্ভর ও সিস্টেম-নির্ভর একটি সার্ভিস। এটি অনলাইন স্টোরে পণ্য বা সেবা কেনার মতোই একটি অর্থনৈতিক লেনদেন।

এই টাকাটি আমি পরবর্তীতে যেভাবে ব্যবহার করি, চাইলে মোবাইল রিচার্জ, বিদ্যুৎ বিল পেমেন্ট বা অন্যান্য ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে পারি, কিংবা ক্যাশ আউট করতে পারি। ক্যাশ আউটের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট সার্ভিস চার্জ কেটে নেয়, যেটা তারা তাদের অপারেশনাল খরচ ও লাভের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গ্রাহক যখন শুরুতেই টাকা জমা দেওয়ার সময় সার্ভিস নিয়েছেন, তখন তার প্রতিটি লেনদেন ধাপে ধাপে অতিরিক্ত চার্জের মুখোমুখি হওয়া কতটা যৌক্তিক ও ন্যায্য?

এখানে নৈতিকতার একটি দিক উঠে আসে, যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের প্রতিটি পদক্ষেপকে একটি চার্জযোগ্য ‘সেবা’ হিসেবে দেখছে, অথচ প্রকৃতপক্ষে এটি একটিই ধারাবাহিক লেনদেনের অংশ। একে যদি ই-কমার্স হিসেবে ধরা হয়, তাহলে গ্রাহকের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বচ্ছ লেনদেনের অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, গ্রাহকের প্রয়োজন ও সুযোগকে পুঁজি করে প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত চার্জ বসিয়ে মুনাফাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এতে গ্রাহকের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে এবং স্বাভাবিক লেনদেন প্রক্রিয়াও জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।

এই অবস্থায় প্রশ্ন করা যায়, সেবার নামে গ্রাহকের ওপর একের পর এক চার্জ আরোপ কতটা ন্যায়সংগত?

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসার ও গ্রাহকবান্ধব সেবা নিশ্চিত করার কথা বললেও বাস্তবে কি এই উদ্দেশ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা হচ্ছে? নাকি এগুলো শুধুই প্রচারণার ভাষা, যার আড়ালে লুকিয়ে আছে অতিমুনাফার কৌশল?

শেষ কথা, আমার মতে, ওয়ালেট লোড ফি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা হলেও এর পেছনের যুক্তিগুলো যেমন শক্তিশালী, তেমনি এটি নৈতিক বিতর্কেরও জন্ম দেয়। ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম যত দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে, ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রকদের উচিত একটি ব্যালেন্স তৈরি করা, যেখানে স্বচ্ছতা, ব্যবহারকারীর স্বাধীনতা ও নীতিমালার সামঞ্জস্য বজায় থাকবে।

এস এম শামীম হাসান 
ইমেইল : shamimcorporate@gmail.com

নবীনতর পরবর্তী কনটেন্ট